প্রকাশিত: ০৬/০৩/২০১৮ ৭:৫১ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ৫:৪৬ এএম

এজাজুল হক মুকুল::
আগামী জাতীয় নির্বাচকে সামনে রেখে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা সাইনবোর্ডর্বস্ব ৭৬টি রাজনৈতিক দলের একটিও নিবন্ধনের শর্ত পূরণ করতে পারেনি। তাই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তাদের কাউকেই নিবন্ধন দেয়া হচ্ছে না। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
রির্বাচন কমিশনের যুক্তি, নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা এ সব দলের রাজনৈতিক কর্মকা- দৃশ্যমান নয়; ঠিকানাহীনও। বেশিরভাগই অপরিচিত, নামসর্বস্ব ভূঁইফোড়া সংগঠন। নিবন্ধর পাওয়ার জন্য এই সময়ে তাদের উপস্থিতি। নিবন্ধন পেতে তারা কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, আবাসিক ভবন, নিজ বাসা অথবা মুদিদোকানকে কেন্দ্রীয় কার্যালয় হিসেবে দেখিয়েছেন সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছে।

ইসির মতে, নিবন্ধনের শর্ত পূরণ করতে গিয়ে, এরা (নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা দলগুলো) দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নামে বিভিন্ন স্থানে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রেখেছে। সেই সঙ্গে জেলা-উপজেলায়ও সাইনবোর্ড লাগিয়েছে। নিবন্ধনের শর্তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এমন আবেদনপত্র জমা দিয়েছে। অফিসের জন্য বাড়িওয়ালার সঙ্গে ভুয়া চুক্তি করেছে। অন্যের দলের গঠনতন্ত্র চুরি বা কপি করে আবেদন করেছে। এমনকি মসজিদকেও নিজেদের কার্যালয় হিসেবে দেখিয়েছে।
সব মিলিয়ে আবেদন করা ৭৬টি দলের জমা দেয়া কাগজপত্রের তথ্য যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছে ইসি। তথ্য যাচাই করে নিবন্ধনে যোগ্য একটিও দল খুঁজে পায়নি যাচাই-বাছাই কমিটি।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, এই সব সমস্যার করণে দলগুলোর আবেদন যাচাইয়ের শুরম্নতে ‘বাছাই কমিটি’র অনেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। কারণ প্রতিটি আবেদনই ছিল অগোছালো ও ভুল তথ্য সংযুক্ত।
ইসির ভাষ্য মতে, নিবন্ধিত দলের সংখ্যা বাড়ুক অনেক বড় দল তা চাইছে না। অবশ্য শর্তপূরণ করে আবেদন করলে যে কোনো দলকে নিবন্ধন দিতে ইসি বাধ্য। আবেদনগুলোর যে অবস্থা তাতে নিবন্ধন দেয়া প্রায় অসম্ভব বলে মনে করছে ইসি।
রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইনে বলা হয়েছে, নিবন্ধন পেতে হলে একটি দলকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে কোনো নির্বাচনে অন্ত্মত একটি সংসদীয় আসনে জয়লাভ করতে হবে অথবা যে কোনো একটি জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে ওই আসনে প্রদত্ত মোট ভোটের ৫ শতাংশ পেতে হবে, অথবা দলের একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয় থাকতে হবে, অন্ত্মত ২১টি প্রশাসনিক জেলায় কার্যালয়, জেলা কমিটি থাকতে হবে এবং অন্ত্মত ১০০ উপজেলা, মেট্রোপলিটন বা থানায় কমপক্ষে ২০০ ভোটারের সমর্থনের প্রমাণিক দলিল থাকতে হবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, তিনটির মধ্যে একটি শর্ত পূরণ হলেই নিবন্ধনের যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। এ সব শর্ত কোনো দলই সম্পূর্ণ পূরণ করতে পরিনি বলে ইসির দাবি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইসির ঊধ্বর্তন এক কর্মকর্তা বলেন, বিএনপির গঠনতন্ত্র কপি-পেস্ট করে নিজ দলের গঠনতন্ত্র বলে চালিয়ে দিয়েছে একটি দল। কিন্তু এক জায়গায় বিএনপির নামটি থাকলেও তা মুছে নিজ দলের নামটি যে বসানো দরকার সেটা করতেও ব্যর্থ হয়েছে ওই দলটি। আবার গঠনতন্ত্র লিফলেট ও ছাপানো আকারে দিয়েছে দু-একটি দল। এ সব দেখে বোঝা যাচ্ছে, তদন্ত্মে গেলে সব মিথ্যা এ সব প্রমাণিত হবে।
আরেক কর্মকর্তা বলেন, নতুন দলের তথ্য যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে পুরো ধাক্কা খেতে হচ্ছে। কোনো একটি দলের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে বলে তাদের গঠনতন্ত্রে উলেস্নখ করেছেন। কিন্তু বাস্ত্মবে কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বাছাই কমিটির এক উপ-সচিব বলেন, নতুন দলগুলোর তথ্য যাচাই করেছেন। যোগ্য কাউকে পাননি। আগামী ২০২০ সালের মধ্যে দলের সর্বস্ত্মরে ৩৩ শতাংশ মহিলা নেতৃত্ব থাকবে গঠণতন্ত্রে তা উলেস্নখ নেই। প্রতিটি উপজেলায় ২০০ ভোটারের স্বাক্ষর থাকা বাঞ্চনীয় তা পুরো তথ্য ঘেঁটে কোথাও যাওয়া যায়নি। বিগত নির্বাচনে (নিবন্ধনের আগে) ওই দল কত শতাংশ ভোট পেয়েছে কাগজপত্র ঘেঁটে বোঝা যাচ্ছে তা পুরোপুরি তৈরি করে (বানানো) দেয়া। একটি দল তাদের ব্যাংকের স্থিতি দেখিয়েছেন মাত্র ১ হাজার টাকা; যা ভুয়া।
আরেক উপ-সচিব বলেন, পার্টির সর্বস্ত্মরে নির্বাচিত নেতৃত্ব থাকতে হবে, কারো গঠনতন্ত্রে সেটি নেই। নিবন্ধনের শর্তনুযায়ী তৃণমূলের মতামত ও ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত কমিটি থাকবে এই তথ্যের বদলে একটি দল বলেছে, সভাপতি মনোনীত হবেন। বাকি কয়েকজন নির্বাচিত হবেন। কোনো কোনো দল বিস্ত্মারিত ঠিকানা না দিয়ে শুধু ছাতক, সুনামগঞ্জ এতোটুকু উলেস্নখ করেছে।
অন্য আরেকজন উপ-সচিব বলেন, নিবন্ধনের আবেদনপত্রের সঙ্গে ৫ হাজার টাকার ট্রেজারি চালান দেয়নি কোনো কোনো দল। দলের গঠনতন্ত্র কি; সে সম্পর্কে নূ্যনতম ধারণা নেই বেশিরভাগ দলের। তিনি বলেন, একটি দল প্রধান কার্যালয়ের অফিস মসজিদ-মার্কেট দেখিয়েছে। অন্য একটি দল নিবন্ধনের জন্য গত ১৭ নভেম্বর ইসিতে আবেদন করেছে। সংশিস্নষ্ট দলটি আবেদন জমা দেয়ার দু’দিন আগে তাদের দলের অফিসের জন্য এক বাড়িওয়ালার সঙ্গে চুক্তি করেন যা তাদের তথ্য ঘেঁটে পাওয়া গেছে।
‘বেঙ্গল জাতীয় কংগ্রেস-বিজেসি’ নামে একটি নতুন দল নিবন্ধনের আবেদন করেছে। দলটির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন নিজের যে ফ্ল্যাট বাসায় পরিবার নিয়ে থাকেন সেটাকেই দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় হিসেবে দেখিয়েছেন। আবাসিক ভবনটি রাজধানীর তেজগাঁওয়ের তেজকুনিপাড়ার বিজয় সরণি টাওয়ার নামে পরিচিত।
আর ‘নাকফুল বাংলাদেশ’ নামক দলের আবেদনে অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কার্যালয় দেখানো হয়েছে রাজধানীর উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরের বিএনএস সেন্টারের দশম তলা। কিন্তু সেখানে কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যালয় নেই। সেটি একটি গার্মেন্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
কর্মকর্তারা আরও জানান, রাজধানীর তোপখানা রোডের বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ ভবন যেন রাজনৈতিক দলগুলোর জন্মস্থান। ২২/১ তোপখানা রোডে অবস্থিত ওই ভবনে ইসিতে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে এমন চারটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ মঙ্গল পার্টির অফিসও। এ ছাড়া বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) ও বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (বাংলাদেশ জাসদ) অফিসও একই ভবনে।
নিষিদ্ধ দলের তথ্য দেয়নি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবের কাছে সরকার ঘোষিত নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলের তালিকা চেয়ে গত মাসে চিঠি দেয় ইসি। নিবন্ধনের জন্য যাচাই-বাছাইয়ের সুবিধার্থে এ তালিকা চাওয়া হয়। ইসির উপসচিব মো. আবদুল হালিম খান স্বাক্ষরিত ওই চিঠির কোনো জবাব দেয়নি মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে কোনো তথ্য না পেলে (রোববার) তাগিদপত্র পাঠায় কমিশন।
উলেস্নখ্য, চলতি মাসে নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। নিবন্ধন দিতে ৩০ অক্টোবর আবেদন আহ্বান করে ইসি। ৩১ ডিসেম্বর ছিল আবেদন জমা দেয়ার শেষ দিন। এর আগে দশম সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আগ্রহী নতুন ৪৩টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের আবেদন করে। এর মধ্যে ৪১টিই নির্বাচন কমিশনের কাছে নিজেদের ‘যোগ্যতার’ প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়। মাত্র দুটি দল শর্ত অনুযায়ী মাঠপর্যায়ে কার্যালয় ও কমিটি থাকার তথ্য দেয়। এরপর তাদের নিবন্ধন দেয় কমিশন। দল দুটি হলো- বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) ও সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন প্রথা চালু করে ইসি।

পাঠকের মতামত

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষীদের নিতে জাহাজ আসবে এ সপ্তাহেই

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসা দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সদস্যদের ফের ...